বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রাতুল খানের গল্প—দ্বিতীয় পৃথিবী


বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রাতুল খানের গল্প—দ্বিতীয় পৃথিবী

বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রাতুল খানের গল্প—দ্বিতীয় পৃথিবী

ধীরে ধীরে নরম সবুজ ঘাসের লনের ওপর অবতরণ করল মহাকাশযানটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের মানুষগুলো স্বচ্ছ জানালার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বিস্ময়ে নিশ্বাস আটকে এল সবার, মুখগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এক জানালা থেকে আরেক জানালায় ছুটে গেল তারা, যেন তাতে বাইরের দৃশ্যগুলো বদলে যাবে। মোট সতেরোজন অভিযাত্রী আছে মহাকাশযানে। যে গ্রহে তারা নেমেছে, সেটার আনুষ্ঠানিক নাম এরিবোস-৭। কিন্তু অনেক দিক দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে মিল থাকার কারণে ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’ নামেও ডাকা হয় গ্রহটাকে। মহাকাশযানটা যেখানে নেমেছে, সেটাকে ছোটখাটো একটা শহর বলা যেতে পারে। মহাকাশযানের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে শহরের রাস্তা, রংবেরঙের বাড়িঘর, ছোট-বড় ভবন আর উপাসনালয় দেখা যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া, শিরীষ, কাঠগোলাপসহ বিভিন্ন গাছ।

‘এটা অসম্ভব,’ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে বলল ফার্স্ট অফিসার জামিল আশরাফ।

‘এমনটা হতেই পারে না, একেবারেই না,’ বলল ভূতত্ত্ববিদ ইশরাত ফারজানা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রহটির বাতাসের রিপোর্ট নিয়ে হাজির হলো আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ শাহেদ ইকবাল।

‘বাতাস শ্বাস নেওয়ার সম্পূর্ণ উপযোগী, স্যার।’ ঘোষণা দেওয়ার সুরে বলল সে।

কিছু না বলে মাথাটা সামান্য একটু নাড়লেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ আরমান। এই অভিযানে সতেরোজনের দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

‘তাহলে এবার আমরা গ্রহে নামতে পারি,’ বলল দলের সবচেয়ে চঞ্চল সদস্য বায়োলজিস্ট প্রান্ত ঘোষ।

‘দাঁড়াও,’ সবার উৎসাহে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। ‘এখানে আসলে ঠিক কী হচ্ছে, সেটা তো আমরা কেউই জানি না। তাই না?’

‘শহরটা দেখতে একেবারে পৃথিবীর কোনো শহরের মতো,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল ইশরাত। ‘ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক!’

তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ।

‘তোমার কি সত্যিই মনে হয়, কোটি কোটি মাইল ব্যবধানের দুটো ভিন্ন গ্রহের সভ্যতা একই গতিতে, ঠিক একইভাবে বিকশিত হতে পারে?’

‘আমার মনে হয় না সেটা কোনোভাবেই সম্ভব, স্যার’, বলল ইশরাত। ‘কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছি, খুবই অদ্ভুত!’

আবার জানালার বাইরে তাকালেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ।

‘অদ্ভুত না। অসম্ভব। একেবারেই অসম্ভব। গোটা ব্যাপারটাই ভীষণ গোলমেলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। আর ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে এখান থেকে বের না হওয়াই ভালো।’

‘কিন্তু নিশ্চিত হব কী করে, স্যার?’ জানতে চাইল জামিল। ‘খোলা চোখে দেখে তো মনে হচ্ছে, বিপদের আশঙ্কা নেই।’

‘আর থাকলেও–বা কী!’ ঠোঁট উল্টে বলল নিরাপত্তাপ্রধান সাখাওয়াত ইসলাম। ‘আমাদের কাছে যে অস্ত্র আছে, তাতে গোটা শহরটা উড়িয়ে দিতে লাগবে বড়জোর চল্লিশ সেকেন্ড!’

‘শান্ত, সবুজ, সুন্দর একটা শহর,’ মুগ্ধ কণ্ঠে বলল জামিল। ‘ঠিক আমার নিজের শহরের মতো।’

‘কোন শহর, জামিল?’

‘কুমিল্লা, স্যার।’

‘আর তোমার শহর কোনটা, ইশরাত?’

‘যশোর, স্যার। মজার ব্যাপার কী জানেন, স্যার? এই শহরকে আমার কাছেও নিজের শহর বলে মনে হচ্ছে।’

‘আমার জন্ম রাজশাহীতে,’ থমথমে কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। ‘ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আমার কাছেও শহরটাকে খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। যেন এই শহরেই বেড়ে উঠেছি আমি।’



‘খুবই রহস্যময় ব্যাপার, স্যার,’ বলল জামিল। ‘আমার ধারণা, এই রহস্য সমাধানের জন্য বাইরে গিয়ে সরেজমিনে খতিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

‘হুম!’ একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ, তারপর বললেন,

‘জামিল, ইশরাত আর আমি—আমরা তিনজন বের হব। শহরটা ঘুরে দেখব। বাকি চৌদ্দজন আপাতত মহাকাশযানেই থাকবে। আমরা নিরাপদ সংকেত দিলে, যাকে যাকে বের হতে বলব, তারাই শুধু বের হবে। আর যদি কোনো বিপদের আভাস দেখো, সঙ্গে সঙ্গে উড়াল দেবে। বাধ্য না হলে আক্রমণ করবে না। আর আমাদের জন্য অপেক্ষাও করবে না। এটা আমার নির্দেশ।’***

নিঃশব্দে খুলে গেল মহাকাশযানের দরজা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল তিন অভিযাত্রী, পা রাখল অজানা এক গ্রহে।

সুন্দর একটা দিন, অনেকটা পৃথিবীর বসন্তকালের মতো। এমনকি কাছাকাছি কোথাও থেকে একটা কোকিলের ডাকও শোনা যাচ্ছে। গাছ থেকে পাতা আর ফুলের পাপড়ি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। কাছেই কোথাও পিয়ানো বাজছে, সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসজুড়ে। একদম শান্তি শান্তি পরিবেশ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রাস্তায় কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।

‘চলো, ওই বাড়িটার ঘণ্টি বাজাই। দেখি কেউ আছে কি না।’ প্রস্তাব দিলেন ক্যাপ্টেন।

মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেল জামিল, তারপর নির্দ্বিধায় কলবেলে চাপ দিল।

দরজা খুলে দিলেন এক মহিলা। বয়স প্রায় চল্লিশ বছর, স্নিগ্ধ চেহারাটায় হালকা বিরক্তির ছাপ।

‘কী চাই?’ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

‘ইয়ে… মানে!’ ইতস্তত করতে লাগল জামিল। ‘এটা কোন জায়গা?’

জামিলের দাদুর বাড়ির বসার কামরায় এসে বসেছে জামিল, ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ আর ইশরাত। কামরাটা একদম ছিমছাম। দেখলেই ভালো লাগে।

মহিলা ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন চোখের সামনে আস্ত পাগল দেখছেন।

‘এটা কি কোনো খেলা?’

‘না, কোনো খেলা নয়,’ তাড়াতাড়া বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন। ‘দেখুন, আমরা এসেছি পৃথিবী থেকে!’

‘কোথা থেকে এসেছেন বললেন?’

‘পৃথিবী থেকে। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির…’

‘আপনারা পৃথিবী থেকে এসেছেন!’ ক্যাপ্টেনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন মহিলা। ‘তাহলে আমরা কোথায় আছি? কোত্থেকে যে আসে এরা!’

মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

***

হতভম্ব হয়ে দরজার সামনেই বসে পড়ল তিনজন।

‘কোথাও কি ভুল হয়েছে আমাদের?’ নিচু কণ্ঠে বলল ইশরাত। ‘হয়তো কোনোভাবে আবার পৃথিবীতেই নেমে পড়েছি!’

‘কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?’ হতভম্ব কণ্ঠে বলল জামিল।

‘সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই,’ বললেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। ‘প্রতিটি মাইলের হিসাব আছে আমাদের কাছে। মূল কম্পিউটার সঠিক দূরত্ব দেখিয়েছে। চাঁদ পেরিয়ে এসেছি আমরা, মঙ্গল পেরিয়ে এসেছি।’

কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। বললেন, ‘চলো, আরেকটা বাড়িতে কথা বলে দেখি।’

পরের বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল তিনজনের দলটা। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল জামিল। রাস্তার ওপাশের কোনো দৃশ্য দেখে থেমে গেছে সে।

‘স্যার…’

‘কী হয়েছে, জামিল?’

‘নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না, স্যার! এ আমি কী দেখছি!’ আবেগে যেন কেঁদে ফেলবে সে। ওর মুখে বিস্ময় আর আনন্দের মিশ্র ছাপ। যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। কেউ বাধা দেওয়ার আগেই একছুটে রাস্তার অন্য পাশে চলে গেল সে।

‘জামিল! সাবধান!’ চিৎকার করে দৌড় দিলেন ক্যাপ্টেন। তার পেছন পেছন ইশরাত।



সাদা রঙের একটা বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়ল জামিল। কলবেলের কথা ভুলে গিয়ে সদর দরজায় পাগলের মতো ধাক্কা মারতে শুরু করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল দরজাটা।

‘দাদি! দাদু!’ চেঁচিয়ে উঠল জামিল।

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওকে দেখে।

‘জামিল!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তাঁরাও। গভীর আবেগে জামিলকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘কত বছর পর তোকে দেখলাম! কত বড় হয়ে গেছিস! কত লম্বা হয়ে গেছিস, দাদুভাই!’

‘দাদি, দাদু!’ আর কোনো কথা বলতে পারছে না জামিল। কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের বুকে মুখ গুঁজল সে।

‘ভেতরে আয়, দাদুভাই। লেবুর শরবত বানানো আছে!’

***

‘দাদি, আপনারা এখানে কত দিন ধরে আছেন?’ প্রশ্ন করল জামিল।

জামিলের দাদুর বাড়ির বসার কামরায় এসে বসেছে জামিল, ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ আর ইশরাত। কামরাটা একদম ছিমছাম। দেখলেই ভালো লাগে।

‘অনেক বছর হলো,’ নরম কণ্ঠে বললেন দাদি। ‘যেদিন আমরা মারা গেছি, সেদিন থেকেই।’

‘কী বললেন! মারা গেছেন…?’ প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ।

‘হ্যাঁ,’ ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল জামিল। ‘দাদু-দাদি মারা গেছেন বিশ–পঁচিশ বছর আগে।’

‘আর তুমি স্বাভাবিকভাবে এটা বলছ। এখানে বসে লেবুর শরবত খাচ্ছ!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন ক্যাপ্টেন।

‘চেঁচিয়ো না,’ ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে প্রায় ধমকের সুরে বললেন বৃদ্ধা। তারপর নিজের সরু কবজিটা এগিয়ে দিলেন।

‘ধরে দেখো।’

ক্যাপ্টেন ধরলেন। পালস একদম স্বাভাবিক।

‘কিছু বুঝতে পারলে?’

মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন। ‘আপনারা যে বেঁচে আছেন, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন বা কীভাবে, সেটা বুঝতে পারছি না।’

‘আমরাও না।’ দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন দাদু। ‘আমরা শুধু জানি, আবার বেঁচে উঠেছি আমরা। এটা এমন এক পৃথিবী, যেখানে আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন, কিন্তু হঠাৎ দূরে কোথাও থেকে অনেক মানুষের কোলাহল, চিৎকার, উল্লাস আর উচ্ছ্বাসের শব্দে থেমে গেলেন।

***

দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ, জামিল আর ইশরাত। সামনের সবুজ লন পেরিয়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল তারা। এখান থেকে মহাকাশযানের অবতরণের জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়। চোখের সামনের দৃশ্যটা দেখে অবিশ্বাসে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের। মহাকাশযানের দরজাটা হাট করে খোলা। ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে অভিযাত্রীরা। নিচে ভিড় জমে গেছে। অভিযাত্রীরা তাদের উদ্দেশে হাত নাড়ছে। লোকগুলোও তাদের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, হাসছে, হাত মেলাচ্ছে। ছোট ছেলেমেয়েরা লাফাচ্ছে। ‘হুর রে’ বলে চিৎকার করছে। একদল ব্যান্ড পার্টি আনন্দের সুর বাজাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাকাশযানটা ফাঁকা হয়ে গেল। প্রত্যেক অভিযাত্রীকে কোনো মা, কোনো বোন বা ভাই, কোনো আত্মীয় বা বন্ধু সঙ্গে করে নিয়ে গেল নিজ নিজ বাড়ির দিকে। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একে একে বন্ধ হয়ে গেল দরজাগুলো।

শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সারা দিনের উত্তেজনা থিতিয়ে এলে মাথাটা পরিষ্কার হতে শুরু করল ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের। যুক্তি দিয়ে ভাবার ক্ষমতা ফিরে পেলেন তিনি।

‘আমার নির্দেশ অমান্য করে মহাকাশযান ছেড়ে বের হয়ে গেল ওরা!’ রাগে চিৎকার করে উঠলেন ক্যাপ্টেন। ‘ওদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনব আমি! অ্যান্ড্রোমিডার কসম!’

‘স্যার,’ নরম কণ্ঠে বলল ইশরাত, ‘ওদের প্রতি কঠোর হবেন না। এত বছর পর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের দেখা পেয়ে নিজেদের সামলাতে পারেনি।’

‘এটা কোনো অজুহাত নয়!’

‘কিন্তু, স্যার। আপনি যদি আপনার কোনো আপনজনকে দেখতেন, আপনার কেমন লাগত।’

‘যেমনই লাগুক। আমি হলে আদেশ অমান্য করতাম না! আমি…’ ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হলো না, মুখ খোলাই রয়ে গেল।

‘ভাইয়া!’ একুশ-বাইশ বছর বয়সী এক যুবক ছুটে আসছে ক্যাপ্টেনকে লক্ষ্য করে।

‘কে?’ ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল।

‘ইমতিয়াজ ভাইয়া, সত্যি তুমি!’

যুবক দৌড়ে এসে প্রথমে ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের হাত ধরল, তারপর জড়িয়ে ধরল।

‘ইশতিয়াক! আমার ছোট ভাই! অনেক বছর আগে পানিতে ডুবে…’ কথা অসমাপ্ত রেখেই থেমে গেলেন ইমতিয়াজ। জামিল আর ইশরাতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত নিজেদের কোনো আপনজনের দেখা পেয়ে চলে গেছে ওদের সঙ্গে। বড় ভাইয়ের পিঠে মৃদু ঘুষি মারল ইশতিয়াক। বলল ‘চলো। মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘মা?’

‘হ্যাঁ, আর বাবাও।’

‘বাবাও?’ ক্যাপ্টেনের বুকের মধ্যে যেন মোচড় দিয়ে উঠল।

‘মা বেঁচে আছেন? বাবাও? কোথায় তাঁরা?’

‘কোথায় আবার? আমাদের পুরোনো বাড়িতে!’



***

দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের মা, আর তাঁর পেছনেই বাবা। দুজনকেই প্রাণবন্ত লাগছে।

‘মা! বাবা!’

ছোট্ট ছেলের মতো দৌড়ে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। মা-বাবাও সস্নেহে বুকে টেনে নিলেন ছেলেকে।

দুপুরের খাবার শেষ করে বসার ঘরে গল্পের আসর বসল। বিকেলটা দারুণ কাটল। মা-বাবাকে নিজের মহাকাশযানের কথা, ক্যাপ্টেন হওয়ার গল্প শোনালেন ইমতিয়াজ। মা শুধু হাসলেন আর মাথা নাড়লেন। রাতে ছেলের প্রিয় ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করলেন।

‘তোকে ক্লান্ত লাগছে, বড় খোকা,’ রাতের খাওয়া শেষে বললেন বাবা। ‘ইশতিয়াকের সঙ্গে ওপরে যা। তোর পুরোনো ঘর সাজিয়ে–গুছিয়ে রেখেছে তোর মা।’

‘পুরোনো ঘর?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। সেই পিতলের খাট। আজ আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাব!’ হাসতে হাসতে বলল ইশতিয়াক।

***

পরম শান্তিতে নিজের পুরোনো বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। পাশে ইশতিয়াকও শুয়ে পড়ল।

শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সারা দিনের উত্তেজনা থিতিয়ে এলে মাথাটা পরিষ্কার হতে শুরু করল ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের। যুক্তি দিয়ে ভাবার ক্ষমতা ফিরে পেলেন তিনি।

কীভাবে? কীভাবে সম্ভব এসব? কেন? কার জন্য?

এরিবোস-৭। দ্বিতীয় পৃথিবী। মা। বাবা। ইশতিয়াক। পুনর্জীবন। ভিনগ্রহ। ভিনগ্রহবাসী।

হঠাৎ অদ্ভুত একটা চিন্তা খেলে গেল তাঁর মাথার ভেতর। হাস্যকর চিন্তা! কিন্তু চিন্তাটাকে কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করে দিতে পারলেন না। শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে গেল তাঁর।

যদি…যদি এমন হয় যে নিজেদের গ্রহে আমাদের মহাকাশযানটাকে নামতে দেখেছিল এই গ্রহের অধিবাসীরা। আর ব্যাপারটা তারা একদমই পছন্দ করেনি। দেখামাত্র আমাদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ধ্বংস করে দেবে আমাদের। কিন্তু আমাদের কাছে আছে ভয়ংকর অস্ত্র। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র কী হতে পারে? উত্তর একটাই: টেলিপ্যাথি, হিপনোসিস, স্মৃতি আর কল্পনা।

যদি এমন হয়, এই শহর, বাড়িঘর, গাছপালা কোনো কিছুই আসলে বাস্তব নয়। স্রেফ আমাদের কল্পনা! আমাদের দুর্বলতা আর মগজের স্মৃতিকে ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে এসব? সম্মোহনের মায়াজালে বিভ্রান্ত করছে আমাদের? যার ফলে সবকিছুই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে আমাদের কাছে? যদি এমন হয়, পাশের ঘরে শুয়ে থাকা মানুষ দুজন আসলে আমার মা-বাবা নন, বরং দুটো ভিনগ্রহবাসী?

কত নিখুঁত ফাঁদ! প্রথমে জামিলকে, তারপর ইশরাতকে ফাঁদে ফেলল। মহাকাশযানে থেকে যাওয়া সবাই যখন নিজেদের মৃত আত্মীয়-প্রিয়জনকে দেখল, ক্যাপ্টেনের নির্দেশ অমান্য করে বেরিয়ে গেল। স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। আর এখন সবাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে আলাদা আলাদা বাড়িতে। নিরস্ত্র অবস্থায়। মহাকাশযান পড়ে আছে ফাঁকা, পরিত্যক্ত।

আমার ভাই হিসেবে পরিচয় দেওয়া যে মানুষ শুয়ে আছে আমার পাশে, এখন যদি হঠাৎ তার চেহারা পাল্টে যায়? পরিণত হয় একচোখা আর দশ হাত-পাওয়ালা ভিনগ্রহের প্রাণীতে? যদি আমার বুকে ছুরি গেঁথে দেয়? বাকি বাড়িগুলোতেও যদি অন্যরা একই কাজ করে?

চাদরের নিচে হাত কাঁপতে লাগল ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের। যতই ভাবতে লাগলেন, ততই তাঁর মনে হতে লাগল, এটা শুধুই একটা ধারণা নয়, বরং এটাই সত্যি। শরীর ঠান্ডা হয়ে এল তাঁর।

ধীরে ধীরে উঠে বসলেন তিনি। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন। চারদিক নিস্তব্ধ। থেমে গেছে সংগীতের মূর্ছনা। বাতাসও বইছে না। পাশেই শুয়ে আছে তাঁর ‘ভাই’।

খুব সাবধানে চাদর সরালেন তিনি, ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন, যেন শব্দ না হয়।

‘কোথায় যাচ্ছ, ভাইয়া?’ অন্ধকারের ভেতর থেকে তাঁর ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এল।

‘কী?’

‘বললাম, কোথায় যাচ্ছ এত রাতে?’ আবার বলল বরফশীতল কণ্ঠটা।

‘একটু পানি খাব।’

‘কিন্তু তোমার তো পিপাসা পায়নি।’

‘হ্যাঁ, পেয়েছে।’

‘না, পায়নি। আমি জানি।’

দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজ। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন না!



***

পরদিন সকালে এরিবোস-৭ গ্রহের রাস্তায় আবার বেজে উঠল ব্যান্ড পার্টির সুরের মূর্ছনা। তবে এবার সেখানে বাজছে করুণ সুর। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো থেকে ছোট ছোট র‌্যালি বের হয়ে আসছে। কফিনের আকারের লম্বা লম্বা কাঠের বাক্স বহন করছে তারা। সবাই এগিয়ে চলেছে সমাধিক্ষেত্রের দিকে। সেখানে সদ্য খোঁড়া কবরগুলোর মাথার কাছে বসানো হয়েছে নতুন সমাধিফলক। সব মিলিয়ে সতেরোটা কবর আর সতেরোটা সমাধিফলক। শেষকৃত্যে শহরবাসীর সঙ্গে উপস্থিত আছেন ক্যাপ্টেন ইমতিয়াজের মা, বাবা আর ভাই। কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন জামিলের দাদা-দাদিও। কিন্তু তাঁদের এখন আর চেনা যাচ্ছে না। আগুনের তাপে মোম যেভাবে গলে যায়, ঠিক সেভাবেই খুব দ্রুত গলে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে তাঁদের চেহারা। একইভাবে গলে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে শহরের সব প্রাণীর চেহারাও।

সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা সেরে কাঠের কফিনগুলো নামিয়ে দেওয়া হলো গর্তের মধ্যে। কেউ একজন বিড়বিড় করে বলল,

‘গতকাল রাতে সতেরোজন মহৎপ্রাণ মানুষের অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা…’

মাটি ফেলা শুরু হলো কফিনগুলোর ওপরে।

শেষকৃত্যানুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সবাই হেঁটে চলল পরিত্যক্ত মহাকাশযানটার দিকে। ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো ওটাকে, তারপর বিস্ফোরকের সাহায্যে মিশিয়ে দেওয়া হলো ধুলায়।

(সমাপ্ত)

(রে ব্র্যাডবেরির ‘মার্স ইজ হ্যাভেন’–এর ছায়া অবলম্বনে)